Breaking News

পাইলস: কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

পাইলস কী?

পাইলসের কারণ ও চিকিৎসা : পাইলস, যা চিকিৎসা পরিভাষায় হেমোরয়েডস (Hemorrhoids) নামে পরিচিত, মলদ্বারের ভেতরে বা বাইরে শিরা (vein) ফুলে ওঠা একটি রোগ। এটি একটি সাধারণ সমস্যা, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় ৫০% মানুষ তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে ভোগেন। পাইলস সাধারণত দীর্ঘদিন কোষ্ঠকাঠিন্য, মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত চাপ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, বা জীবনযাত্রার কারণে হয়ে থাকে। এটি ব্যথা, রক্তপাত, চুলকানি এবং অস্বস্তির কারণ হতে পারে। তবে সঠিক জীবনধারা ও চিকিৎসার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ বা নিরাময় সম্ভব। উপযুক্ত চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই রোগের প্রভাব কমানো যায়।

পাইলসের ধরণ

পাইলস প্রধানত দুই প্রকার: ইন্টারনাল (Internal) এবং এক্সটারনাল (External)।

১. ইন্টারনাল পাইলস: এটি মলদ্বারের ভেতরে হয় এবং বাইরে থেকে দেখা যায় না। এ ধরনের পাইলসে সাধারণত তীব্র ব্যথা অনুভূত না হলেও মলত্যাগের সময় রক্তপাত হতে পারে। কখনো কখনো এটি মলদ্বারের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে, যাকে প্রোল্যাপসড হেমোরয়েড বলা হয়।

২. এক্সটারনাল পাইলস: এটি মলদ্বারের বাইরের ত্বকে হয়। এতে তীব্র ব্যথা, চুলকানি, ফোলাভাব এবং বসার সময় অস্বস্তি হয়। কখনো এতে রক্ত জমাট বেঁধে থ্রম্বোসিস হতে পারে, যা আরও বেশি ব্যথার কারণ।

কিছু ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির উভয় ধরনের পাইলস একসঙ্গে হতে পারে, যা অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দেয়।

পাইলস হওয়ার কারণ পাইলসের কারণ ও চিকিৎসা

পাইলস হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যা জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস এবং শারীরিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রধান কারণগুলো হলো:

  • কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া: দীর্ঘদিন কোষ্ঠকাঠিন্য বা পাতলা পায়খানার কারণে মলদ্বারে অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যা পাইলস সৃষ্টি করে।
  • মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত চাপ: মলত্যাগের সময় বেশি জোর দেওয়া বা দীর্ঘক্ষণ টয়লেটে বসে থাকা শিরায় চাপ সৃষ্টি করে।
  • গর্ভাবস্থা: গর্ভাবস্থায় পেটে চাপ বাড়ে, যা পাইলসের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • কম ফাইবারযুক্ত খাবার: ফাইবার কম খাওয়ার ফলে মল শক্ত হয়, যা কোষ্ঠকাঠিন্য এবং পাইলসের কারণ।
  • অতিরিক্ত ঝাল-মশলা বা ফাস্টফুড: এ ধরনের খাবার হজমে সমস্যা সৃষ্টি করে এবং পাইলসের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজন পেলভিক এলাকায় চাপ বাড়ায়, যা পাইলসের কারণ হতে পারে।
  • দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা: দীর্ঘসময় বসে কাজ করা (যেমন ডেস্ক জব, ড্রাইভিং) রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত করে এবং পাইলসের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • জেনেটিক কারণ: পরিবারের কারও পাইলসের ইতিহাস থাকলে এটি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

পাইলসের লক্ষণ

পাইলসের লক্ষণগুলো পর্যায়ের ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:

  • মলত্যাগের সময় বা পরে রক্তপাত, যা টয়লেট পেপার বা মলে দেখা যায়।
  • মলদ্বারের চারপাশে ফোলা বা গুটির মতো অনুভূতি।
  • টয়লেটের পর অসম্পূর্ণ মলত্যাগের অনুভূতি।
  • বসার সময় তীব্র ব্যথা বা অস্বস্তি।
  • মলদ্বারে চুলকানি, জ্বালা বা অস্বস্তি।
  • উন্নত পর্যায়ে ফোলাভাব বা ব্যথা বেড়ে যাওয়া।

প্রাথমিক পর্যায়ে রক্তপাতই প্রধান লক্ষণ হতে পারে, কিন্তু উন্নত পর্যায়ে ব্যথা ও জটিলতা বাড়তে পারে।

চিকিৎসা ও প্রতিকার

পাইলসের চিকিৎসা রোগের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে। প্রাথমিক পর্যায়ে জীবনধারা পরিবর্তন এবং ঘরোয়া প্রতিকার কার্যকর হতে পারে। গুরুতর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন।

১. জীবনধারার পরিবর্তন:

  • প্রতিদিন ২–৩ লিটার পানি পান করা।
  • ফলমূল, শাকসবজি এবং ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার (যেমন ওটস, ডাল, আঁশযুক্ত শস্য) খাওয়া।
  • নিয়মিত ব্যায়াম, যেমন হাঁটা বা যোগাসন, যা রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে।
  • টয়লেটে দীর্ঘক্ষণ বসে না থাকা এবং মোবাইল বা বই ব্যবহার না করা।
  • ঝাল-মশলাযুক্ত খাবার এবং ফাস্টফুড এড়িয়ে চলা।

২. ঘরোয়া প্রতিকার:

  • গরম পানিতে সিটবাথ: দিনে ২–৩ বার ১০–১৫ মিনিট গরম পানিতে মলদ্বার ভেজানো ব্যথা ও ফোলাভাব কমায়।
  • অ্যালোভেরা বা নারকেল তেল: মলদ্বারে প্রলেপ দিলে চুলকানি ও জ্বালা কমে।
  • উইচ হ্যাজেল: এটি প্রাকৃতিকভাবে ফোলাভাব কমাতে সাহায্য করে।
  • ঠান্ডা সেঁক: ব্যথা ও ফোলাভাব কমাতে ঠান্ডা পানির সেঁক দেওয়া যায়।
  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া এবং অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম এড়ানো।

৩. চিকিৎসকের পরামর্শ:

  • প্রাথমিক পর্যায়ে ডাক্তারের পরামর্শে মলম (যেমন হাইড্রোকর্টিসোন বা লিডোকেন মলম) বা সাপোজিটরি ব্যবহার করা যায়।
  • উন্নত পর্যায়ে নন-সার্জিকাল পদ্ধতি, যেমন:
    • রাবার ব্যান্ড লিগেশন: পাইলসের গোড়ায় রাবার ব্যান্ড বেঁধে রক্ত সরবরাহ বন্ধ করা।
    • স্ক্লেরোথেরাপি: পাইলসে রাসায়নিক ইনজেকশন দিয়ে সংকুচিত করা।
    • ইনফ্রারেড কোয়াগুলেশন: তাপ প্রয়োগ করে পাইলস সঙ্কুচিত করা।
  • জটিল ক্ষেত্রে হেমোরয়েডেক্টমি নামক সার্জারি প্রয়োজন হতে পারে, যেখানে পাইলস অপসারণ করা হয়।

পাইলস প্রতিরোধে করণীয়

পাইলস প্রতিরোধে স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যায়:

  • প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে মলত্যাগের অভ্যাস গড়ে তোলা।
  • দীর্ঘক্ষণ বসে না থেকে মাঝে মাঝে হাঁটা বা দাঁড়ানো।
  • শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
  • নিয়মিত ব্যায়াম, যেমন হাঁটা, সাঁতার বা যোগাসন।
  • পর্যাপ্ত পানি (দিনে ৮–১০ গ্লাস) এবং ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ।
  • অতিরিক্ত ঝাল-মশলা বা প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়ানো।

উপসংহার পাইলসের কারণ ও চিকিৎসা

পাইলস একটি সাধারণ কিন্তু অস্বস্তিকর রোগ, যা অনেকে লজ্জার কারণে গোপন রাখেন। তবে সময়মতো চিকিৎসা না নিলে এটি জটিল আকার ধারণ করতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে জীবনধারা পরিবর্তন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং ঘরোয়া প্রতিকারের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গুরুতর ক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে পাইলসের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। সুস্থ জীবনধারাই এই রোগ থেকে মুক্তির প্রধান চাবিকাঠি।

About abdulgoni

Check Also

আদার স্বাস্থ্য উপকারিতা

আদা: স্বাস্থ্য উপকারিতা, ব্যবহার এবং পুষ্টিগুণ

আদা (Zingiber officinale) একটি জনপ্রিয় মসলা এবং ঔষধি উদ্ভিদ, যা বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক এবং প্রাকৃতিক চিকিৎসায় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *